দশকের তো বটেই, ইতিহাসেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কনসার্ট হিসেবে বিবেচিত হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।
ছবি: সংগৃহীত
মঞ্জুরুল ইকরাম:
রবিশঙ্কর ভেবেছিলেন, সবাই মিলে একটা কনসার্ট করলে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য হাজার পঁচিশেক ডলার নিশ্চয়ই তোলা যাবে। বলা হচ্ছে একাত্তর সালের কথা, যখন রবিশঙ্কর প্রস্তাবটি প্রথম তোলেন জর্জ হ্যারিসনের কাছে। এর বছর দুয়েক আগে হ্যারিসন ব্যক্তিগতভাবে রবিশঙ্করকে নিয়ে ‘মেসেঞ্জার আউট অব দি ইস্ট’ নামে ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন, অনেকটা গুরুর প্রতি শিষ্যের নিবেদন। কনসার্টের প্রস্তাবে তাই হ্যারিসন এক কথাতেই রাজি।
বলা হতো তখন বিটলস ছিলো ঈশ্বরের চেয়েও জনপ্রিয়। কিন্তু হ্যারিসনের সাথে তার ব্যান্ডমেটদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। জন লেনন ও পল ম্যাকার্টনি কোন রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, জর্জ গান বোঝেনা, এমনকি ওর চেয়ে ভালো গিটার প্লেয়ারেরও অভাব নেই!
যাইহোক, রকস্টারের ইগো শিকায় তুলে বিটলসের বাকি তিন বন্ধুকে ফোন করলেন জর্জ। ওজর ছাড়াই রাজি হলেন একমাত্র রিঙ্গো স্টার, বিটলসের ড্রামার। জন লেনন শর্ত দিলেন, বউ ইয়োকো ওনোকে গাইতে দিতে হবে। রাজি হলেন না জর্জ।
রোলিং স্টোনের মিক জ্যাগারও আসবেন বলেছিলেন, ভিসা না পাওয়ায় শেষে আর আসা হয়নি। আপত্তি ছাড়াই রাজি হয়েছিলেন বিল প্রেস্টন, লিওন রাসেল, জিম কেল্টনার। কিন্তু জর্জের জন্য আসল ক্যু ছিল বব ডিলান এবং এরিক ক্ল্যাপটন। দুজনই বললেন ভেবে দেখবেন। গেঁজেল বলে দুজনের খ্যাতি জগতজোড়া। স্টেজে না ওঠা পর্যন্ত এদের ভরসা নেই।
অনুষ্ঠানের দিন, ১ অগাস্ট, ১৯৭১ এর সকালে জর্জের হোটেলে ডিলান গিটার হাতে হাজির। খুশিতে জর্জ অনুরোধ করলেন, ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড গাইতে হবে। এবার বেঁকে বসলেন ডিলান, উনি নতুন গান করবেন, না হলে নাই! রাজি হলেন জর্জ এবং অনুষ্ঠানের সময় দেখেন স্টেজে উঠবেন কি উঠবেন না, এই নিয়ে দ্বিধায় ডিলান। কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়াই জর্জ হ্যারিসন ঘোষণা করলেন বব ডিলানের নাম।
মাইকে গিয়ে ডিলান শুরুই করলেন “হাউ মেনি রোডস মাস্ট আ ম্যান ওয়াক ডাউন.. দ্য আন্সার মাই ফ্রেন্ড ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড..” দিয়ে।
এরিক ক্ল্যাপটনও লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছালেন তার নির্ধারিত ফ্লাইটের অনেক পরে। যারা তাকে আনতে গিয়েছিল তারা সারাদিন অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে। অনেক রাতে এক বান্ধবীকে নিয়ে এরিক ঠিকই পৌঁছালেন। পৌঁছেই বান্ধবীকে পাঠালেন হেরোইন খুঁজে আনতে। অবশ্য এরিক যখন ম্যাডিসন স্কয়ারের স্টেজে উঠলেন, তার গিটারের অলৌকিক ঝঙ্কারে কারো মাথায় আর আসেনি কিছুই।
কনসার্ট শুরু হয়েছিল রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খানের যুগলবন্দী দিয়ে, সাথে তবলায় আল্লা রাখা। আর কনসার্টের মেগাস্টার ডিলান ও হ্যারিসন।
অনুষ্ঠানের ফিনালে হিসেবে জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন সেই আশ্চর্য গান, বাংলাদেশ। বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা ও উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই হ্যারিসন গানটা লিখেছিলেন। লিরিকের পরিকল্পনা ছিল লিওন রাসেলের, এরকম যে, বাংলাদেশের সমস্যার কথা সবাই জানে না। তাই গানের শুরুতেই সঙ্কটে ব্যাপারটা যেন বলা হয়। থিমটা মনে ধরে হ্যারিসনের। তিন-তিনবার খসড়ার পর বন্ধু রবিশঙ্করের কথা দিয়েই তা শুরু,
My friend came to me,
With sadness in his eyes,
Told me that he wanted help,
Before his country dies…
তথ্যসূত্র: হাসান ফেরদৌস, ১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া।
Leave a reply