গায়ের রঙে বৈষম্য: যে গল্পের শেষ নেই

|

আল মাহফুজ:

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
…কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক কালো মেয়ের রূপ দেখে লিখেছিলেন এই চরণগুলি। গানটি শুনতে বেশ মধুর লাগে। পুরো গান জুড়ে কালো বরণ কন্যার তারিফ। তবে কেন বিশ্বকবিকে ‘তা সে যতই কালো হোক’ এই শব্দরাজির ওপর আলাদা জোর দিতে হলো?

২০২১ সালে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকা ‘কালো, তবু সুন্দর’ শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশ করে। কেন সেখানে কালো বলার সাথে ‘তবু’ অব্যয়ের ডাক পড়লো? গায়ের রঙ কালো বা তামাটে হলে সে কি সুন্দর নয়? সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এ প্রসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, সৌন্দর্য তো গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করা উচিত না। কিন্তু সেটাই হচ্ছে সমাজে।

মিস ইউনিভার্স ২০১৯-এর বিজয়ীর মুকুট পরানো হচ্ছে জোজিবিনী টুনজিকে।


সৌন্দর্যের সাদা কালা

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাধারণত ‘সুন্দর’ বলতে ফর্সা মানুষকে বোঝানো হয়। কিন্তু গায়ের রঙ যদি কালো হয়, তাহলে এ অঞ্চলের মানুষকে বিশেষত নারীকে সুন্দর ভাবা হয় না কখনোই। সৌন্দর্য ধারণাটির সঙ্গে গায়ের রঙয়ের সম্পর্ক কেন খোঁজা হয়?

ফর্সা শব্দটির আভিধানিক ইংরেজি হলো ‘ফেয়ার’। ‘ফর্সা’ তাই মানুষের মনে ইতিবাচক অর্থ বহন করে। যেমন আমরা খুব ভালো মানুষ বোঝাতে বলি ‘সাদা’ মনের মানুষ। তেমনি কালো শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক অর্থ জড়িত। অন্ধকার আর কালোকে সমার্থক হিসেবে দেখা হয়। কালো বা অন্ধকার জগত, কালো দিবস, কালো হাত, অন্তর কালা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারিক দিক দেখলে আমাদের কাছে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়। গায়ের রঙয়ের ক্ষেত্রে এই মনোভাব বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষিতে আপেক্ষিক হলেও তৃতীয় বিশ্বে তা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে।

শুধু উপমহাদেশকে নমুনা হিসেবে নিলে দেখা যাবে, এখানকার সমাজে এই বর্ণবাদী ধারণা বদ্ধমূলভাবে গেঁথে রয়েছে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের কথা বিবেচনা করলে তামাটে বা শ্যামলা বরণকে সাধারণের গায়ের রঙ ধরা যায়। কিন্তু আমরা পর্দার নায়ক বা নায়িকার গায়ে নিজেদের ত্বকের রঙটাকে ঠিক হজম করতে পারি না। আমরা নাটক, সিনেমা বা ভিজ্যুয়াল কোনো মাধ্যমে অবচেতনভাবেই ফর্সা নায়ক বা নায়িকাকে দেখতে চাই। ওই যে শুরুতেই বলা হলো, এই অঞ্চলের মানুষ ‘ফর্সা’ আর ‘সুন্দর’কে গুলিয়ে ফেলে। বিশেষত ‘সুন্দরী’ মেয়ের বর্ণনায় তারা ভাবে স্লিম ফিগার, লম্বা চুল, সূঁচালো নাক আর টকটকে ফর্সা রং। তাদের কাছে কারও গায়ের রঙ ফর্সা হওয়া মানে সে সুন্দর বা আকর্ষণীয়। আর কালো ত্বক মানে তার গায়ের রঙ ‘ময়লা’।

অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী


বলিউডে গায়ের রঙ বৈষম্য

সাধারণত বিনোদন জগতের তারকাদের ফর্সা ত্বকের অধিকারী দেখে থাকি আমরা। এ কারণে আমাদের বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে শোবিজের সব জায়গায় বেশিরভাগ সময়েই ফর্সা চেহারা ভেসে ওঠে। এ কারণে বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীকে টুইট করতে হয় কেবল গায়ের রঙ কালো বলে– আমাকে এটা বোঝানোর জন্য ধন্যবাদ যে, ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম হিরোদের সাথে আমাকে কাস্ট করা যায় না। কারণ আমি কালো চামড়ার আর দেখতে খারাপ

যদিও বলিউডের জমকালো অঙ্গনে ‘দম লাগাকে হাইসা’, ‘বালা’ ইত্যাদির মতো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এই সিনেমাগুলোতে গৎবাঁধা ধারণা বা স্টেরিওটাইপ ভাঙার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেটা সংখ্যায় নেহায়েত কম। ‘দম লাগাকে হাইসা’ ছবিতে যেমন স্ফীত শরীর নিয়ে অভিনয় করতে দেখা যায় ভূমি পেড়নেকারকে। অতিরিক্ত ওজনের এমন মেয়েকে সমাজে মানুষের নানা কটুকথার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বলিউডের কিছু কিছু নির্মাতা এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করছেন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। যদিও মেইনস্ট্রিম সিনেমা এখনও তথাকথিত ছিপছিপে গড়নের প্রথাগত ‘সুন্দরী’কেই তালিকার শুরুতে রাখে।


দেশের শোবিজের চালচিত্র

এ দেশের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রঙ শ্যামলা, কিন্তু কজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের এ রঙ নিয়ে পর্দায় আসতে দেখা যায়? কিছু দিন আগেও গ্ল্যামারাস নায়ক বলতে ফর্সা ত্বকের নায়ককেই বোঝানো হতো। এখন শোবিজে বেশ কয়েকজন প্রধান অভিনেতা বা নায়ককে দেখা গেলেও শ্যাম বর্ণের নায়িকাদের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। শ্রীদেবী থেকে কাজলসহ অনেক বলিউড অভিনেত্রীকে মেলানিন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে চামড়া ফর্সা করতে দেখা গেছে। আর বাংলাদেশে যারা কালো বা শ্যামবর্ণের আছেন, তাদের অনেককেই দেখা যায় রঙচঙ করে ফর্সা হতে। অনেকে আবার বলিরেখা দূর করতে বোটক্স ট্রিটমেন্টের দিকেও ধাবিত হন।


আমাদের দেশে টিভি নাটকে এই প্রথা ভাঙার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নির্মিত অনেক নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা পাত্র-পাত্রীর গায়ের রঙ সাধারণ মানুষের মতো তামাটে হতো। এরপর পুরোদমে এই ট্যাবু ভাঙলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও তার ভাই ব্রাদাররা। তাদের বানানো টিভি ফিকশনের উল্লেখযোগ্য দিক থাকতো নায়ককে চেহারাকেন্দ্রিক না করে চরিত্রকেন্দ্রিক করা। প্রটাগনিস্ট হতেন যেকোনো উচ্চতা বা গায়ের রঙয়ের অধিকারী। এক্ষেত্রে অভিনেতা হাসান মাসুদ অথবা সুমন পাটোয়ারীর কথা বলা যেতে পারে। যারা গায়ের রঙ বা আকারের কারণে নয়, নাটকে অভিনয় করেন নিজস্ব যোগ্যতায়।

পরের দিকে সালাহউদ্দিন লাভলু-বৃন্দাবন দাসরাও এই ট্রেন্ড ফলো করেন। তবে তাদের নাটকের প্রেক্ষাপট হতো গ্রাম কেন্দ্রিক। নায়কের চেহারায় থাকতো মাটির ছাপ, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন তারা। এই নতুন ধারার নাটক, টেলিফিল্মগুলোর ক্যারেক্টারগুলো দর্শকের মনে ঠাঁই পায়। তাদের বানানো নাটকে নায়কের বয়স, কম উচ্চতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্ফীত দেহ, মাথার টাক অথবা গায়ের কালো ত্বক– সবকিছুকেই খুব ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমরা দেখতে পাই, সেসব ফিকশনের নায়িকারা এমন পুরুষ চরিত্রের নায়কের প্রেমে পড়ছেন-ভালোবাসছেন; যা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক চিত্র।


অন্যদিকে, ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামে নায়িকাদের উপস্থাপন করা হচ্ছে কীভাবে? নায়িকারা কিন্তু থাকছেন কম বয়সী, ফর্সা সুন্দরী নারী চরিত্র হিসেবেই। বিজ্ঞাপন, টিভি নাটক, মেইনস্ট্রিম সিনেমা সবখানেই এই চিত্র বিদ্যমান। জীবন ঘনিষ্ঠ সিনেমাকে এক পাশে সরিয়ে রাখলে বলতে হয় যে, নায়িকাদের ক্ষেত্রে এই স্টেরিওটাইপ ভাঙার উদাহরণ প্রায় শূন্যের কোটায়। আমাদের বড় বা ছোট পর্দায় নায়িকাদের গায়ের রঙ ফর্সা থাকে। নায়িকাদের শরীর সাধারণ মানুষের মতো স্ফীত হয় না, বেশি বয়স্ক হয় না। শেষ পর্যন্ত নারীর গায়ের বরণ বা ফিগার কি তবে তার যোগ্যতা আর সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে? এক্ষেত্রে ‘আকর্ষণীয় কিছু দেখার মানসিকতা লালন করা দর্শক’দের ঘুম ভাঙাতে চান না কেউ। ঝুঁকি আছে বলেই? টিআরপি বা ভিউয়ারশিপের খেরোখাতার পাতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে? এক্ষেত্রে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী বা সালাউদ্দিন লাভলুরা হাঁটছেন পুরনো পথেই। একটু ‘ঝুঁকি’ নিয়ে যে বর্তমান সমাজের দৃষ্টিতে ‘কালো’ বা ‘স্থুল’ কাউকে প্রধান নারী চরিত্রে উপস্থাপন করা যায়, সে আগুনে হাত রেখেছেন কমই। যদিও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ফারুকীর ছবি ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’তে সমাজে বিদ্যমান গায়ের রঙের বৈষম্য নিয়ে সাহসী ফোকাস করা হয়েছে।


চাই মানসিকতা পরিবর্তন

তার মানে কি এই ট্যাবু কখনও ভাঙবে না? এই মানসিকতার বদল ঘটাতে করণীয় কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের স্বপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রঙ যাই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কালো ও ফর্সা ত্বকের অধিকারী উভয় নারীকেই এই চেতনা বিপ্লবে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। ফর্সা ত্বকের নারীরও গর্ব হতে হবে তার যোগ্যতায়-কর্মফলে, ত্বকের রঙের জন্য নয়।

সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণার যে শেকড় সমাজের গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা অনায়াসে তুলে ফেলা যায় না। সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সাথে সাথে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতার। সমাজবিদ ডু বয়েস তার এক লেখায় বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দির প্রধান সমস্যা হলো বর্ণবৈষম্য। একবিংশ শতাব্দিতেও এই বৈষম্যের শেকড় ছড়ানো থেকে আমরা নিস্তার পাইনি। কবি রে ডারেমের এই কবিতাটি পড়লে এখনও তার কিছুটা আঁচ করা যায়—

“আমার কিছু কিছু বন্ধু আছে
যাদের চামড়ার রঙ সাদা
অথচ আমি তো তাদের সঙ্গে
ঠিক ব্যবহারটা করি
অন্য সব মানুষের মতোই..”


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply