৩০ ফেব্রুয়ারি, ইতিহাসে মাত্র একবারই এসেছিল যে দিন!

|

এক বছর বলতে ৩৬৫ দিন। সাধারণত এমন হিসাব করা হলেও ২০২৪ সালে বছরের গণনা করা হবে ৩৬৬ দিনে। চলতি বছরেই কেন বছরের খেরোখাতায় একদিন যোগ হলো?

কারণ, চলতি বছর হলো ‘লিপ ইয়ার’। ৩৬৫ দিনের ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারির সমাপ্তি ঘটে ২৮ দিনে। কিন্তু ‘লিপ ইয়ার’ বা অধিবর্ষে ফেব্রুয়ারিতে বাড়তি একটি দিন যোগ হয়। অতিরিক্ত এই এক দিনকেই ‘লিপ ডে’ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত প্রতি চার বছর পর এমন দিনের দেখা মেলে। তাই ২৯ ফেব্রুয়ারি অবশ্যই বিশেষ একটি দিন।

যারা এই তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা নিজেদের হয়তো দুর্ভাগা ভাবেন। কারণ, প্রতি চার বছর পর তাদের প্রকৃত জন্মদিন ক্যালেন্ডারের পাতায় ভেসে আসে। কিন্তু জানেন কি, ইতিহাসে মাত্র একবার ক্যালেন্ডারের পাতায় ৩০ ফেব্রুয়ারি দেখা গিয়েছিল?

এখনকার প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয় হলেও ঘটনা কিন্তু সত্য। একটি ডাবল লিপ ইয়ারের অংশ হিসেবে সুইডেন ১৭১২ সালের ক্যালেন্ডারে ৩০ ফেব্রুয়ারি যুক্ত করেছিল। একবার ভেবে দেখুন, সেই দিন যারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাদের ভাগ্যে কী হয়েছে? তারা কি পরবর্তীতে তাদের জন্মদিন ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি ‘শুভ’ দিন পাল্টে নিয়েছিলেন? কারণ, তাদের জীবদ্দশায় কখনোই সত্যিকারের জন্মদিন উদযাপন করতে পারেননি তারা।

লিপ ইয়ারের প্রচলন

কারও কারও মতে, পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে কাঁটায় কাঁটায় ৩৬৫ দিন সময় নেয় না। এতে ৩৬৫ দিনের সাথে পাঁচ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড বেশি সময় লাগে। সুতরাং রোজকার ক্যালেন্ডারে যে অসঙ্গতি থাকে, সেটিকে সমন্বয় করতে লিপ ইয়ারের আবির্ভাব হয় চার বছর পরপর।

এই ক্যালেন্ডারের প্রাথমিক ধারণা কখন থেকে এসেছিল, সেই গল্প জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ২ হাজার ৬৬ বছর আগে। অর্থাৎ খ্রিস্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে। সেই সময় প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল– তারা যে সৌর ক্যালেন্ডার ধরে বছর গণনা করতো, সেটি সৌর বছরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

রোমান ক্যালেন্ডারের নমুনা 

তথ্য অনুসারে, রোমানরা ৩৫৫ দিনের একটি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো। রোমানরা জানতো, সৌর বছর ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা দীর্ঘ, তাই তাদের অধিবর্ষকে (২ বছর পর অধিবর্ষ হতো তখন) সৌর বছরের সাথে মেলাতে অতিরিক্ত ২২/২৩ দিন যোগ করতো। ফলে রোমান ক্যালেন্ডারে বছরের দিনসংখ্যা হতো ৩৫৫ দিন। আর অধিবর্ষে হতো ৩৭৭ বা ৩৭৮ দিন। এটি অনেক বিভ্রান্তিকর ছিল।

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার সেসময় ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ৩৬৫ দিনের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলেন এবং প্রকৃত গণনাটি করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোসিজেনেস। প্রতি চার বছর পর পর আসন্ন বছরে একদিন যোগ করে এর নাম দেয়া হয় ‘লিপ ইয়ার’। প্রবর্তক জুলিয়াস সিজারের সম্মানে এভাবে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’-এর জন্ম হয়।

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংশোধন

কিন্তু এই জুলিয়ান ক্যালেন্ডারও বেশিদিন টেকেনি। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রবর্তন করেন নতুন এক বর্ষপঞ্জির। তিনি হিসাব করে বের করে দেখেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর ১১ মিনিটের গরমিল থাকায় ইস্টার ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছিল।

এই গরমিল সমাধানের জন্য গির্জার পক্ষ থেকে ১১ দিন যোগ করে প্রবর্তন করা হয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, যা এখন আমরা অনুসরণ করি। ১৫৮২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের জায়গা প্রতিস্থাপন করে নেয় আজকের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে বছর শুরু হতো মার্চ থেকে (বসন্তের কারণে)। যেহেতু প্রতি চার বছরে একটি অতিরিক্ত দিনের প্রয়োজন ছিল, তাই রোমানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এটি ফেব্রুয়ারিতে হবে, যা তখন বছরের শেষ মাস ছিল।

পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি

ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে ক্যালেন্ডারটিকে ‘নিখুঁত’ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার আনা পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি ছিল– লিপ ইয়ারের অতিরিক্ত দিনটি হবে ২৯ ফেব্রুয়ারি। সেটা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার দ্বারা নির্ধারিত ২৪ তারিখ নয়।

সুইডেনে ৩০ ফেব্রুয়ারির প্রবর্তন

যারা ক্যাথলিক চার্চের সাথে যুক্ত ছিল, প্রথমে তারা এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। পরবর্তী চার দশকে লিপ ইয়ার নির্মূল করার পরিবর্তে তারা অক্টোবর মাস থেকে এক লাফে ১০ দিন কমিয়ে দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াসের পরামর্শে ১৫৮২ সালে ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের পরের দিন ১৪ অক্টোবর শুক্রবার করা হয়।

সুইডেন যখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা হঠাৎ করে ওই দিনগুলোকে একসাথে বাদ দিতে চায়নি। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোকে যথার্থ বলে মনে করেছিল। এজন্য তারা টানা ৪০ বছর ফেব্রুয়ারির লিপ দিনগুলো এড়িয়ে যায়, যতক্ষণ না সেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৭০০ সালে তাদের একটি লিপ ইয়ার হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শুধুমাত্র ২৮ দিনেই কাটায় তারা। একইভাবে অব্যাহত থাকে ১৭০৪, ১৭০৮ সালও। লিপ ইয়ার হলেও সেবছরগুলোতে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল তারা।

কিন্তু ওই সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং অন্যান্য অগ্রাধিকারমূলক কাজের মধ্যে এই লিপ ইয়ার না কাটানোর পরিবর্তনের কথা তারা ভুলে যায়। কয়েক বছর পরে সম্রাট দ্বাদশ চার্লস বুঝতে পারেন, সুইডেনের ক্যালেন্ডারটি ‘জুলিয়ান’ বা ‘গ্রেগরিয়ান’ কোনটিই হয়তো নয়। এরপর তিনি ক্যালেন্ডার প্রণয়নে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং আগের সব পরিবর্তন বাতিল করেন।

কিন্তু যেহেতু তাদের ক্যালেন্ডার থেকে ১৭০০ সালের অধিবর্ষ বাদ পড়েছিল, তাই সম্রাট ১৭১২ সাল অর্থাৎ আরেকটি লিপ ইয়ারে ২৯ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি আরেকটি অতিরিক্ত দিন যোগ করার আদেশ দেন। এভাবে জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৩০ ফেব্রুয়ারি তারিখটি তৈরি করা হয় ক্যালেন্ডারে।

ওই তারিখে যারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, জন্ম তারিখ বা জন্মদিন পালনের বিষয়ে তারা কী করেছিলেন, তা আমরা জানি না। তবে তারা যে সত্যিকারের জন্মদিন উদযাপন করতে পারেনি কোনোদিন, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

তবে এই ব্যবস্থা বেশি দিন ছিল না সুইডেনে। শেষ পর্যন্ত উত্তর ইউরোপে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে দেশটি। ১৭৫৩ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে তারা।

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply