উর্দু সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিয়ে আলোচনা কেন?

|

দিল ক্যায়া কারে সিরিয়ালের দৃশ্য।

সম্প্রতি পাকিস্তানের একটি টিভি সিরিয়ালের পরিচালক মেহরিন জব্বার তার ‘দিল ক্যায়া কারে’ সিরিয়ালের একটি দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ওই দৃশ্যে দেখা যায় ঘরোয়া আবহে বসে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে। সেখানে একটি নারী চরিত্র সাবলীল বাংলায় গাইছে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘আমারও পরান যাহা চায়’ আর অন্যরা তা শুনছে। এসময় শ্রোতাদের মুগ্ধ অভিব্যক্তি দেখানো হয়েছে।

এই দৃশ্য নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা। অনেকেই এই দৃশ্যটি শেয়ার করে নানান প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। জনপ্রিয় শিল্পীদের গান বা শিল্পকর্ম পাশের দেশে এমনকি বিশ্বজুড়ে প্রচার হওয়ার দৃশ্য নতুন নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো জনপ্রিয় একজন কবির গান পাকিস্তানে প্রচার হওয়া নিয়ে আলোচনার পেছনে রয়েছে নানান ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। তৎকালীন বাংলাদেশের মানুষ এই সিদ্ধান্তকে দেখেছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি পাকিস্তানিদের বিদ্বেষ হিসেবে। এমনকি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালির ক্ষোভের আগুনে হাওয়া দিয়েছিলো এমন ঘটনা, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রভাবক।

স্বাধীনতার পর রবীন্দ্রনাথের গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হওয়াও পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিদ্বেষের প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন অনেকে। ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানকে রবীন্দ্রবিদ্বেষী বলে মনে করে। কিন্তু পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাম্প্রতিক চিত্র দেখাচ্ছে উল্টো দৃশ্য। একটি উর্দু টিভি সিরিয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খালেদ হোসাইন বলেন, প্রেমের খুব সাধারণ কিছু অনুভূতি নিয়েই উল্লিখিত গানটি রচিত। এসব অনুভূতি সীমানা নির্বিশেষে সর্বজনীন। অনুভূতির কোনো কাঁটাতার নেই; তাই রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষত এই গানটি সব দেশের সব মানুষের অনুভূতিকেই নাড়া দেবে এটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, আমরা যখন মেহেদী হাসানের গান শুনি, লতা মঙ্গেশকরের গান শুনি তখন তাদের জাতীয়তা আমাদের শিল্পবোধকে প্রভাবিত করে না। তেমনই রবীন্দ্রনাথের গানও পাকিস্তানের মানুষ শুনবে তাতে কোনো অসঙ্গতি নেই।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে রবীন্দ্রবিদ্বেষ প্রচার করেছিলো, কিন্তু উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের আবেদন চিরন্তন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

রবীন্দ্রনাথের গান সর্বজনীন হলেও ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানে এমন দৃশ্য হয়তো খুব বেশি দেখা যাবে না। রাজনৈতিকভাবে দুই মেরুতে থাকা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রাজনীতি এমনকি সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ চোখে পড়ার মতো। ভারতে উর্দুভাষী কিংবদন্তী গায়কদের দেশত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। একইমাত্রার চিত্র পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশেও আছে। তবে তরুণ প্রজন্ম ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সীমানার অপচর্চা করে না বলে মনে করেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ।

অধ্যাপক সাজ্জাদ বলেন, আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ বেশ প্রগতিশীল। তারা অনর্থক জাতিবিদ্বেষে বিশ্বাস করে না। পাকিস্তানের সমসাময়িকদের লেখা পড়ে দেখেছি, তারা বাংলাদেশ এমনকি ভারতের ব্যাপারেও বিদ্বেষের চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককেই প্রাধান্য দেন। এই সময়ে এমন দৃশ্য প্রত্যাশিত। এই দৃশ্য পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতাকেই প্রকাশ করছে।

দিল ক্যায়া কারে সিরিয়ালটি ২০১৯ সালে পাকিস্তানের টেলিভিশনে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় সিরিয়াল। পরিচালক মেহরিন জব্বার জানিয়েছেন, বাংলা ওই গানটি  শর্বরী পাণ্ডে গেয়েছেন।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply