নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ

|

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান:

আজ ২৭ নভেম্বর শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন দিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বৈরশাসকের ‘গোপন বাহিনীর’ গুলিতে তিনি নিহত হন। তার রক্তদানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চার হয় এবং ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। নিশ্চিত হয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের বীর শহীদ ডা. মিলনের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট জন্মদাত্রী মা সেলিনা আক্তারের কোল আলোকিত করেছিলেন আমাদের মিলন। সদালাপী, মিষ্টভাষী, কর্মে আন্তরিক মিলন ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিলেন প্রগতিশীল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিন্তাধারার এই মানুষটি ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেই চিকিৎসকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন।

অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগঠক, চিকিৎসক, সমাজের প্রিয় নাম শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন ছিলেন আমার শিক্ষক। আমার স্যার। আমার অহংকার। আমি তখন ইউএনবি (ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ)-র মেডিকেল করেসপন্ডেন্ট। পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র। সেই সুবাদে প্রিয় শিক্ষক ডা. মিলন রাজপথে হয়ে যেতেন ‘মিলন ভাই’। অনেক ক্লান্ত দুপুরে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টের শেষের কামরাটি জনশূন্য হয়ে যেত, স্যার ডেকে পাঠাতেন। কখনো বা নিজেই হাজির হয়ে যেতাম। গরম গরম সিঙারা সাথে আলোচনা হতো বিএমএ’র ২৩ দফা, বিএমএ’র ধর্মঘটে সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, স্বৈরাচারের চাপিয়ে দেয়া কুখ্যাত স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। কখনো বা একেবারে মামুলি আলাপ। পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান। এভাবেই জেনেছি তাকে। দেখেছি ডা. মিলনের স্বপ্নকে।

সারাদেশে তখন একদফা আন্দোলন। এরশাদকে হঠানোর এক বিশাল আয়োজন। সময়ের সাথে সাথে ঘনীভূত হচ্ছিল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। সেই সাথে বুঝি ক্যালেন্ডারের পাতায় ঘনিয়ে আসছিল বিএমএ’র তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক ডা. মিলনের প্রতিবাদী মুখ। মিলন কি বুঝতে পেরেছিলেন জেহাদের মতই তার শরীর চুয়ে পড়া রক্তে ভিজে যাবে রাজপথ?

২৭ নভেম্বর ১৯৯০, সকাল সাড়ে ১০টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র মোড় হয়ে রিকশায় তৎকালীন পিজি হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এর দিকে যাচ্ছিলেন ডা. মিলন। পাশে বসা চিকিৎসক সমাজের প্রাণপ্রিয় নেতা বিএমএ’র তৎকালীন মহাসচিব এবং বর্তমান সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী পার্ক থেকে অকস্মাৎ ঘাতকের থ্রি নট থ্রি’র বুলেট আঘাত করে ডা. মিলনের বুকে। এরপর মাত্র ৫ মিনিট বেঁচে ছিলেন তিনি। হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই মিলন হয়ে উঠেন ক্ষুব্ধ তারুণ্যের শ্লোগান।

২৭ নভেম্বর এলে বুক ভারি হয়ে আসে। সবই কি বৃথা গেল? পরিবর্তিত সময়ে বাস্তবতায় আমরা কী দেখলাম। বিচার হলো কোথায়? আজ ডা. মিলন নেই। স্যার আর কখনো আমাকে ডাকবেন না। আর কখনো তার কথা বলবেন না। ঢাকা মেডিকেলের চত্বরে শুয়ে আছে তার শরীর। তার মাও এখন সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আমি টেলিভিশনে বেশ কটি আলোচনা অনুষ্ঠান করেছি এ বিষয়ে। সবই বৃথা। সেই ছবিটি এখনো মনে আছে। অঝোরে কাঁদছেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। কাঁদছে চিকিৎসক সমাজ। কাঁদছে সারা বাংলাদেশ। আমার হৃদয় ঘিরে খেলা করছে এক জ্যোতির্ময় লাশ। স্যার বলছেন, ‘কানে কানে একটি কথা শোন/আরো কাছে আরও, এইতো এবার শোন/গভীর রাতে একবার এসো…’

ডা. মিলনের মৃত্যু সংবাদ দাবানলের মতো ঢাকা শহরসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। বিক্ষোভে ফেটে পড়লো চিকিৎসক, ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষ। মিলনের শেষশয্যা কোথায় হবে? ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে এই নিয়ে বিএমএ’র নেতৃবৃন্দ আলাপ-আলোচনা করছেন। অতঃপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে তার দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে স্বৈরাচারী সরকার কারফিউ জারি করলো। আমরা সবার আগে মিছিল বের করেছিলাম। এরইমধ্যে প্রিয় আঙিনায় দাফন করা হলো শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়লো। অন্ধকারে একা হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে রাত আরও গভীর করে তুলছে। আমার ঘুম আসে না। হৃদয় জুড়ে একটি নাম, ডা. মিলন। ডায়েরি নিয়ে বসি। ২৭ নভেম্বরের পাতায় অনুভূতি আর যন্ত্রণার আঁকিবুঁকি করি।

কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন, ‘গুলিবিদ্ধ শহর করছে অবিরত অশ্রুপাত। কেন না মিলন নেই। দিন দুপুরে নরকের শিকারি কুকুর তার বুকে বসিয়েছে তীক্ষ্ণ দাঁত। বড় নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।’

২৭ নভেম্বর গুলিবিদ্ধ শহর অবিরত অশ্রুপাতে মিলনের রক্তের দায় মেটায়নি। অতঃপর ডা. মিলনের রক্ত সমাধির ওপর গড়ে ওঠে গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়সৌধ। স্বৈরাচার পতনের প্রয়োজনে মিলন হয়ে ওঠেন আমাদের প্রতিদিনের অহংকার। ৯০ এর গণ অভ্যুত্থান সম্পর্কে ‘নিউজ উইক’ এর মন্তব্য ছিল- ‘ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ড বিদ্যুৎস্পর্শের মতো দাবানল সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে অনির্বাচিত সামরিক সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার কুখ্যাত স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের ঘোষণা দেয়।

স্যার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিন্তাধারার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে তিনি প্রায়ই আক্ষেপ করতেন। মিলনের মা আমাকে বলেছিলেন, ৭১ সালে মিলন ছিলেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাকে সমগ্র বাঙালিকে যার যা আছে তাই নিয়ে লড়ার আহ্বান জানান, তখন অষ্টম শ্রেণির তেজী এই ছাত্র কাঁধে কাঠের বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছিলেন। পাড়ার অন্যান্যদের সাথে তিনিও কাঠের বন্দুক নিয়ে প্যারেড করতেন।

স্যার একটি কথা প্রায়ই বলতেন, ‘ব্যক্তির নয়, ব্যবচ্ছেদ দরকার গোটা সমাজটির। এখানে শহীদ ডা. শাসমুল আলম খান মিলনের একটি লেখার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি- ‘সরকার মূল সমস্যা সমূহের সমাধানের পথে না গিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থার জন্য চিকিৎসকদেরও দায়ী করছেন। অথচ সরকার ২৮ পয়সা বরাদ্দ করে জনগণের কাছে কোন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে চান তা বলছেন না। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ও শক্তিশালীভাবে গড়ে তুললে জনগণ কখনো বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতো না। তাই আজ প্রথম প্রয়োজন সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। অথচ সে পথে না গিয়ে সরকার স্বাস্থ্য বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর ফলে গরীব জনগণ আজ যতটুকু চিকিৎসা পাচ্ছে, তা থেকেও বঞ্চিত হবে। তাই আজ প্রথম প্রয়োজন একটি জনগণের সরকার, যারা জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দেবে।’ (মাসিক গণ সংস্কৃতি পত্রিকা, এপ্রিল ৯০)।

আজ এত বছর পরেও স্বাস্থ্যনীতির বিষয়ে আমরা স্পষ্ট জানি না। করোনাকালে স্বাস্থ্যনীতির বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা দেখি না। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? মিলনের আত্মত্যাগ কি তবে বৃথা যাবে? সারা বছর ধুলোবালি মিশে থাকে মিলনের আঙিনা। আজ ফুলে ফুলে শোভিত হবে। নেতৃবৃন্দ কত কথা বলবেন। তারপর সন্ধ্যা হবে রাত হবে। ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৮ নভেম্বর হবে। আমরা আবার ২৭ নভেম্বর ভুলে যাবো। তবে কি মিলন ভুল করেছিলেন? তবে কি মিলনের আত্মত্যাগের এত বছর পরও একটি সবল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাবো না? আমি বিশ্বাস করি মিলনের স্বপ্ন বৃথা যেতে পারে না। আমরা এমন একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাই, চিকিৎসা সেবা চাই, যাতে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষ সুলভে চিকিৎসা সুবিধা পায়। কেউ যেনো চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়।ধনী গরীব সবাই যেনো সমান সুযোগ পায়।

এই লেখাটি লেখার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টের সেই শেষ কামরাটি বারবার স্মৃতির পাতায় ভেসে আসছে। যেখানে তাকে আমি নানাভাবে জেনেছি, চিনেছি। ক্লান্ত দুপুরের অলস হাওয়ায় সদালাপী অথচ সাহসী সেই মুখ এখনো আমাকে বিহ্বল করে তোলে। বদ্ধ ঘরে থাকতে স্যার ভীষণ অপছন্দ করতেন। প্রায়ই জানালাগুলো খুলে দিতে বলতেন। মুক্ত বুদ্ধির টগবগে এই মানুষটি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত বদ্ধ মাটির ঘরে। মধ্যরাতে যখন লেখাটি লিখছি আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ভাসছে এক জ্যোতির্ময় লাশ। মনে পড়ছে স্যারের ডায়েরির পাতায় তার লেখা কবিতার ক’টি বিশুদ্ধ পঙক্তিমালা-

‘গভীর রাতে তখন
দেখতে পাবে আমার লাশ,
আমার জ্যোতির্ময় লাশ,
তোমার হৃদয় ঘিরে খেলা করছে।’

লেখক: অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply