‘নারী আটকায় কিসে?’ এমন জিজ্ঞাসা কেন?

|

আল মাহফুজ:

নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।

নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।

পৃথিবীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে হলেও নারী ভালোবাসতে জানে। সেই নারীই আরাধ্য ভালোবাসা খুঁজে না পেলে বন্ধন ছিঁড়তে দু’বারও ভাবে না। যদি মন কাঁদে, সব কিছু ছেড়ে চলে আসে এক লহমায়। আর যদি বিষিয়ে ওঠে মন, অজস্র প্রলোভনেও ধরে রাখা যায় না তাকে। যদিও যুগ যুগ ধরে নানা গুণীজন নারীর মন বুঝতে না পারার কথা বলে গেছেন। উপরে উল্লেখিত হেলাল হাফিজের ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌’অনির্ণীত নারী‌’ কবিতাতেও ফুটে উঠেছে তার কিছুটা। যদিও এ দেখাই শেষ দেখা নয়। যুগ যুগ ধরে নানা চোখেও, নানা মতবাদে নারীর মনের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে নানা আঙ্গিকে।

‘যে পুরুষ নারীকে বুঝতে পারে, সে পৃথিবীর যেকোনো জিনিস বুঝতে পারার গৌরব করতে পারে’, এই প্রবাদ বিশ্বাস করে সমাজের অসংখ্য মানুষ। আবার আহমদ ছফার উক্তি ধরে বলা যায়- ‘নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার আকর্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।’

প্রশ্ন আসতেই পারে, চারপাশের নানা ইস্যু পাশে রেখে ‘নারী’ নিয়ে এতো কথা পাড়া হচ্ছে কেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক’দিন ধরেই বহুল চর্চিত আলোচনা- ‘নারী কিসে আটকায়?’। সম্প্রতি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী সোফির বিচ্ছেদের খবর আসার পর সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস, মিম, ট্রলের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এমনই একটি মিম পোস্টের বক্তব্য ছিল এমন- ‘জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতা, বিল গেটসের টাকা, হাকিমির জনপ্রিয়তা, হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসা, তাহসানের কণ্ঠ কিংবা হৃত্বিক রোশানের স্মার্টনেস। কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারেনি। বলতে পারবেন নারী কিসে আটকায়?’ এখানে যেসব পুরুষের নাম নেয়া হয়েছে, তারা সবাই পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে তাদের সঙ্গীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। তবু বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে কেবল নারীর আটকানোর আলোচনা কেন? এই ধরনের ট্যাগলাইনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত সামাজিকমাধ্যমে উপচে পড়ছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আলোচিত সেই মিম। ছবি: সংগৃহীত

সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকজন সচেতন নারী লিখেছেন, ‘পুরুষের সৌন্দর্য, ক্ষমতা বা অর্থে আটকায় না নারী। নারী আটকায় পুরুষের ভালোবাসা, সম্মান ও প্রায়োরিটিতে।’ অনেকে আবার এ কথার ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘নারী আটকায় পুরুষের দাসত্বে, সংসার ও সিদ্ধান্তের অংশীদারিত্বে। পুরুষ যতোই ধনী, ক্ষমতাবান বা স্মার্ট হোক না কেন; যদি সে ঘরে নারীর কাছে দাসত্ব বরণ না করে, সে যদি সাংসারিক সিদ্ধান্তে নারীর মতামতকে প্রাধান্য না দেয়; তবে সে কখনোই অর্ধাঙ্গিনী তথা কোনো নারীকে আটকে রাখতে পারবে না!’ কেউ কেউ আবার এসব বৈষয়িক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে ইমোশন বা নারীর মনস্তত্ব নিয়ে বলেছেন। মুশফিকুর রহমান আশিক নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নারী বা পুরুষ কে কীসে আটকায়, তা জানি না। তবে তীব্র অবহেলা পেয়ে যে মানুষটা চলে যেতে চায়, সে আর কোনো কিছুতেই আটকায় না।’

এসব বক্তব্যের বিপরীতে অনেক নারীই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাল্টা মত দিয়েছেন। সেখানে উঠে এসেছে দেশের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নারীর প্রতি বৈষম্য ও পীড়নের নগ্ন চিত্রের কথা। নারীর আটকানো প্রসঙ্গে একজন লিখেছেন, ‘নারী আটকায় ইন্টারমিডিয়েটের পর বিয়ের প্রস্তাবে। নারী আটকায় বিয়ের পর পড়াশুনা করতে চাইলে।’ সমাজে নারীদের অবস্থান কতটা নাজুক, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় তার এই মন্তব্যে। আরেকজন নারী স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘মর্ম দিতে না জানা পৃথিবীতে আটকে থাকার মানে নেই। কেবল ছাড়িয়ে নিতে হয়। মানুষ কীসে নিজ ইচ্ছায় থেকে যায়? যেখানে তার শান্তি মেলে, যেখানে সে থাকতে চায়, যেখানে তারে কেউ ‘সে’ হওয়া থেকে বিরত রাখে না এবং যেখানে তার বলা না বলা কথারা ব্যক্ত হবার ভরসা পায়।’

জাস্টিন ট্রুডো ও সোভি গ্রেগয়ের ট্রুড। ছবি: সংগৃহীত

অনেকে আবার মুদ্রার উল্টা পিঠ দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব পুরুষের আটকানো প্রসঙ্গে। লেখক মাহবুব মোর্শেদ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘তাহলে পুরুষের মন কিসে আটকায়? আমি তো দেখি, পুরুষের মন কোন কিছুতে আটকায় না। অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সৌন্দর্য, জ্ঞান কোনো কিছু পুরুষকেও আটকাতে পারে না। বরং সত্যি কথা বললে, নারীর চেয়ে পুরুষরা বেশি অস্থির। কোন কিছুই পুরুষকে অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে পারে না। নারীকেও পারে না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে নারীরা স্থির।’

বস্তুত, নারী অথবা পুরুষ কীসে আটকায়, এসব প্রশ্নের মীমাংসা করা সম্ভব না। সময়, সমাজ, বাস্তবতা কিংবা চাহিদার নিরিখে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবই যে আলাদা, তা সে নারীই হোক কিংবা পুরুষ, কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের কেউ। কেউ সঙ্গীর সাথে আজীবন থেকে গেলেই সেটিকে নিছকই আটকে থাকা বলা চলে? থেকে যেতে চাইলে কোনো কারণ ছাড়াই থেকে যাওয়া যায়, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো থাকার জন্য কারণের প্রয়োজন হয়। আশাভঙ্গ থেকে অনেক ক্ষেত্রে থেকে যাওয়ার পণও ভঙ্গ হয়। তাই আটকে থাকায় বা না থাকার আপাত চর্চিত বিষয় ছাপিয়ে দূরের পথচলাও দৃষ্টি নিবদ্ধের সুযোগ আছে বৈকি। মানুষের মনও চাইতে পারে, পাখির মতো প্রাণোচ্ছ্বাসে ডানা মেলাতে। মনোবিজ্ঞানীরাও বলেন, অহর্নিশ সম্ভ্রমহানি হলে সেখানে না থাকাই উত্তম সিদ্ধান্ত। সংসার যদি ক্রমশ বিষে পরিণত হয়, এবং চেষ্টা সত্ত্বেও বিষক্ষয় না ঘটে, সেই নরকে পুড়ে পুড়ে প্রতিদিন জ্বলার কোনো মানে হয় কি? আগুন নেভানোই হয় বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে দহন দাগ মোছার সুযোগ আসে। ভিন্নভাবে জীবনটাকে দেখার সময় পাওয়া যায়। পুড়তে পুড়তে একদিন যদি কেউ (নারী অথবা পুরুষ) পরিত্রাণ খুঁজে পায় এবং ধাবিত হয় সেই স্বস্তির সিরামে, তখন তাকে দোষ দেয়া যাবে কি? তার জন্য সেই সিরাম গ্রহণ দোষের তো নয়ই, বরং অনেক বেশি মুক্তির। অনেক বেশি স্বাধীনতার। সুতরাং, বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে নারী পুরুষ দু’জনেরই। যেমনভাবে রয়েছে একসাথে পথ চলার অধিকারও।

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply