রাশিয়ার ছোট গল্পের ঈশ্বর আন্তন চেখভ

|

আন্তন চেখভ। ছবি: গেটি ইমেজ।

আহাদুল ইসলাম:

একসময় রাশিয়া ছিল সাহিত্যের তীর্থভূমি। যেখানে লিও তলস্তোয়ের মতো পৃথিবীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিকের জন্ম। আন্তন চেখভ, আলেকজান্ডার পুশকিন, ম্যাক্সিম গোর্কি এবং ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির মতো লেখকদের প্রভাব এখনও পাওয়া যায় সাহিত্যের জগতে। এদের মধ্যে রাশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী ছোটগল্প লেখক আন্তন চেখভ। তাইতো লেখকদের মহাগুরু তলস্তয় আন্তন চেখভকে নিয়ে বলেছিলেন, “চেখভ মেয়ে হলে ওকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিতাম”।

আধুনিক ছোটগল্পের গুরুদের কথা উঠলেই তিনটি নাম অবধারিতভাবে আসতে বাধ্য- আন্তন চেখভ, গি দ্য মপাসাঁ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনটি নামই বাঙালির পরিচিত। বহু দশক ধরে এই তিনজন একইভাবে সমাদৃত ও বহুল পঠিত। তবে বলে নেয়া ভালো যে ফরাসি, বাঙালি আর রুশ; এই তিন ভদ্রলোক বাদেও বহু দুর্দান্ত লেখক ছোটগল্প লিখে গিয়েছেন। কিন্তু এই তিনজন নিজস্ব স্টাইল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। যা-ই হোক, সীমিত পরিসরে এই ত্রয়ীর তুলনামূলক আলোচনার দুঃসাহস না দেখানোই উত্তম।

আন্তন পাভলোভিচ চেখভের জন্ম ১৮৬০ সালে, দক্ষিণ রাশিয়ার আজভ সাগরের তীরে। পিতা রুশ; তবে মাতা ইউক্রেনীয়। দেনাগ্রস্ত পিতা ছিলেন বদরাগী। অন্যদিকে, মা ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। চেখভের মা সুন্দর গল্প বলতে পারতেন। কিন্তু অভাবের সংসার হওয়ায় পাওনাদারের ভয়ে পরিবারটি একসময় মস্কোতে পালিয়ে যায়।

এদিকে, আন্তন চেখভের ছদ্ম নাম ‘রাগহীন মানব’। ঠিক বাবার উল্টো। কিশোর চেখভ ছাত্র পড়িয়ে এবং ছোটখাট লেখা লিখে কোনোমতে নিজের খরচ চালিয়ে নিতেন। অল্প বয়সেই প্রতিভাধর লেখক হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ে তার।

মস্কোতে চেখভ পড়েন ডাক্তারি। রাশিয়ায় কলেরা মহামারি দেখা দেওয়ায় বছরখানেক ডাক্তারি করেন, কিন্তু ঐ পেশার মেহনত চেখভের দুর্বল শরীর নিতে পারেনি। তাছাড়া ততদিনে লেখক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বাকি জীবনটা কলম চালিয়েই পার করেন তিনি। মাঝে ছোট একটা ভূ-সম্পত্তি কিনে বছর কয়েক গ্রামে বসবাস করেছেন।

ডাক্তারি পড়ার পর পরই আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। সারাজীবন এ রোগ তাকে ভুগিয়েছে। খ্যাতির গগনে উঠেছেন নাটক আর ছোটগল্প লিখে, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা পিছু ছাড়েনি। শেষ জীবনে, ১৯০১ সালে ওলগা নীপার নামের এক রূপসী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেন। ঠিক গতানুগতিক বিবাহিত জীবন তার ছিল না। স্ত্রী অভিনয়ের পাশাপাশি চেখভের সেবাযত্ন করতেন। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই মহান লেখক মৃত্যু বরণ করেন।

চেখভ লিখেছেন খুব অল্প। কিন্তু তারপরেও তার ছোটগল্পের এত সুনাম কেন? এক্ষেত্রে চেখভের কৃতিত্ব কি?

উত্তর পাওয়া যায় চেখভের ক্লাইম্যাক্সবিহীন গল্পে। চেখভের বেশিরভাগ লেখা প্রচণ্ড বাস্তবমুখী। বাস্তবে আমাদের জীবনে ক্লাইম্যাক্স আর কতখানিই বা আছে? বেশিরভাগ ঘটনাই তো সাদামাটা, বিশেষত্বহীন। চেখভের বিশেষত্ব হচ্ছে এই সাদামাটা, বিশেষত্বহীন জীবনকেই ছোটগল্পে স্থান দেওয়া। কোনো ক্লাইম্যাক্স ছাড়াই সার্থক ছোটগল্প কিভাবে লিখতে হয়, চেখভ তা দেখিয়ে গিয়েছেন। চেখভের ক্লাইম্যাক্স তার গল্পের মতোই জীবনমুখী ও স্বাভাবিক। পড়ে চমক লাগে না, অথচ সাধারণ কাহিনী নিয়ে লেখা গল্পটি শেষে হয়ে ওঠে অসাধারণ।

আন্তন চেখভ ১৮৮৬ সালে একটি ছোট গল্প লিখেন যার নাম ‘হৃদয়ের ব্যাথা’। গল্পের প্রধান চরিত্র আইওনা পোটাপভ, যিনি ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। গল্পটি শুরু হয়েছে তীব্র শীতের সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়ে। গোধূলি সন্ধ্যা, তুষারের বড় বড় টুকরো রাস্তার অলস বাতিগুলোর আসে পাশে পড়ছে। তীব্র শীতে আইওনা বসে আছে জ্যাকেট পরে। তুষারে জামা পুরো সাদা হয়ে গেছে, যেন পুরো ভূতের মতো। এদিকে, তীব্র তুষারপাতে তার প্রিয় ঘোড়াটির গায়ের রংও সাদা হয়ে পড়েছে। ঠিক যেন বৃদ্ধ মালিকের মতো, গতিহীন। সন্ধ্যা নেমে আসছে। কিন্তু সারাদিনে এখন পর্যন্ত নেই একটি যাত্রীও। রাতের খাবারের জন্য কোন টাকাও নেই।

হঠাৎ করে দূর থেকে শব্দ ভেসে আসে, ভাইবোর্গস্কায়া যাবে? তার চোখ দুটো তুষারে ঢাকা। ঝাপসা আলোয় সামরিক ওভারকোট পরিধান অবস্থায় একজন অফিসারকে দেখতে পায় আইওনা। শুরু হয় যাত্রা। গাড়িতে উঠেই রীতিমত ঝাড়ি দেয়া শুরু করলেন অফিসার সাহেব। এক সময় বৃদ্ধ আইওনাকে বলেই বসলেন, ঠিক মতো গাড়িও চালাতে পারো না! অপদার্থ কোথাকার! কি! কিছু বলবে? 

আইওনা একটুখানি মুচকি হাসি দেয় আর ইতস্ত করে বলে “এই সপ্তাহে আমার ছেলে মারা গেছে, স্যার।”

অফিসার জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে?

আইওনা উত্তরে বলল,  কে বলতে পারে! অবশ্যই জ্বর হয়েছিলো। তিন দিন হাসপাতালেও ছিল। তারপর মারা যায়। ঈশ্বরের ইচ্ছা!

সাথে সাথে অফিসার বলল, গাড়ি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! অন্ধকারে নিয়ে যাবে নাকি শয়তান! তাড়াতাড়ি চালাও, এমন গতিতে চললে মনে হয় আগামীকালও পৌঁছাতে পারব না। দ্রুত করো। অবশেষে, অফিসারকে নিয়ে ভাইবোর্গস্কায়া পৌঁছায় আইওনা।

আবার তীব্র শীতে রেস্তোরাঁর পাশে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে আছে আইওনা। তুষারে সাদা হয়ে গেছে তার জামা। অপেক্ষার পালা শুরু। ১ ঘণ্টা শেষ! ২ ঘণ্টা শেষ!

হঠাৎ, তিনজন যুবকের আগমন। দু’জন লম্বা ও একজন খাটো এবং কুঁজো। সে এসে আইওনাকে জিজ্ঞেস করলো, পুলিশ ব্রিজ পর্যন্ত যাবে? আমরা ৩ জন যাবো। ২০ পয়সা পাবে, যাবে?

আইওনা ভাবলো, বিশ পয়সা ন্যায্য দাম না হলেও কোন চিন্তা নেই, ভাড়া পেলেই হলো। কারণ তার প্রিয় ঘোড়াটি কিছু হলেও খেতে পারবে। তাই কিছু না ভেবে, মাত্র বিশ পয়সার জন্য যাত্রা শুরু করে আইওনা।

এদিকে তিনজন যুবক গাড়িতে উঠেই বাজে ভাষা ব্যবহার করা শুরু করে। হঠাৎ কুঁজো যুবকটি আইওনাকে বলল, মাথায় এটা কি ক্যাপ পরেছ? পুরো পিটার্সবার্গে এর থেকে খারাপ ক্যাপ আর নেই !

কুঁজো যুবকটি বলতে লাগলো, তাড়াতাড়ি যাও, ঘোড়াটাকে চাবুক মারো। এতো ধীরে যাচ্ছে কেন! এরপর তিন যুবক নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করে।

লম্বা যুবক বলে, গতকাল দুকমাসোভসে, ভাস্কা ও আমি মিলে চার বোতল ভদকা পান করেছি। আহা! মাথাটা এখন ঘুরঘুর করছে।

এদিকে, আইওনা অপেক্ষা করছে কখন যুবকদের কথা থামবে। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে মনের ভেতর যে কষ্ট অনুভব করছে আইওনা, সেই অনুভূতিগুলো কাউকে বলতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। একাকীত্বের অনুভূতি তাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে খাচ্ছে। তাই কাউকে বলতেই হবে। দুঃখ ভাগাভাগি করতেই হবে। সে আশায় হঠাৎ আইওনা বলে, এই সপ্তাহ আমার ছেলে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে।

এই কথা শুনে কুঁজো যুবক বলে উঠলো, ‘আমরা সবাই মারা যাব’। চালাও! চালাও! আমি ও আমার বন্ধুরা এভাবে হামাগুড়ি দিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না! কখন পুলিশ ব্রিজ পৌঁছাবো?

তুমি কি শুনতে পাচ্ছ পুরাতন প্লেগ রোগী! বুড়ো ড্রাগন! তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও। কুঁজো যুবক হঠাৎ আইওনার ঘাড়ে চড় বসিয়ে দেয়। উত্তরে আইওনা হেসে বলে, ঈশ্বর আপনাকে সুস্থতা দান করুন!

এদিকে লম্বা যুবক আইওনাকে জিজ্ঞেস করে, ক্যাবম্যান! তুমি কি বিবাহিত?

আইওনা হেসে বলে আমি? আমার জন্য এখন একমাত্র স্ত্রী এই স্যাঁতসেঁতে পৃথিবী! কবরই আমার সব এখন। কেননা, আমার ছেলে মারা গেছে আর আমি বেঁচে আছি। কি নির্দয় ঈশ্বর! মৃত্যু এসেছে ভুল দরজায়! আমার জন্য আসার পরিবর্তে আমার প্রিয় ছেলেটিকে নিয়ে গেল।

আইওনা পেছনে ঘুরে যুবকদের জানায় কিভাবে তার ছেলে মারা গেছে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কুঁজো যুবক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘোষণা করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছি। যুবকরা চলে যায়। এদিকে আইওনা আবার একা। সঙ্গে সেই ঘোড়া, নীরবতা আর  নিঃসঙ্গতা।

আইওনার দু’চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন কাউকে, যে তার দুঃখের কথা শুনবে। কিন্তু কেউ নেই, তার কথা শুনার জন্য। অবশেষে, আইওনা ক্লান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে যায়, একাকী ঘরে। একটা বড় নোংরা চুলার কাছে গিয়ে বসে। চুলার মেঝে ও বেঞ্চে অনেক মানুষ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আফসোস করে আইওনা। সেই সাথে দুশ্চিন্তা রয়েছে ছায়ার মতো। প্রিয় ঘোড়াটির জন্য।

আইওনা ঘোড়াটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, আমি যথেষ্ট উপার্জন করিনা। বুড়ো হয়ে গিয়েছি। এজন্যই আমি খুব অসহায়।

হঠাৎ এক কোণে একজন তরুণ ক্যাবম্যান ঘুম থেকে উঠে। একটু পানির জন্য ! আইওনা তাকে জিজ্ঞেস করে, পানি চাই? উত্তরে যুবক বলে, একটু দিন! বলতে বলতেই আইওনা তরুণকে বলে, এই সপ্তাহে হাসপাতালে আমার ছেলে মারা গেছে, তুমি জানো?

যুবকটি পানি পান করে ইতিমধ্যেই মাথা ঢেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আইওনার দুঃখ শুনার কেউ নেই। বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে বলতে থাকে, যুবকটি যেমন পানির তৃষ্ণার্ত ছিল, তেমনি কথা বলার জন্য তৃষ্ণার্ত আমি।

আইওনার ছেলে মারা গিয়েছে। সে এখনও কারো সাথে কথা বলেনি। আইওনা কথা বলতে চান। তিনি বলতে চান কীভাবে তার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কীভাবে সে মৃত্যু যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছিলো। মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কী বলেছিলো আদরের ছেলেটি। কীভাবে মারা গেলো। হ্যাঁ, তার এখনও অনেক কথা বলার আছে।

ছেলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা করতে চায় আইওনা। কীভাবে তার ছেলের কাপড় আনতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। দেশে এখনো তার মেয়ে আনিস্যা আছে। সে তার সম্পর্কেও কথা বলতে চায়। তার শ্রোতার দীর্ঘশ্বাস, চিৎকার আর বিলাপ করা উচিত, এমন দুঃখের ঘটনা শুনে। কিন্তু কেউ নেই।

এই ভেবে ঘোড়াটিকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে আইওনার। ঘুমের জন্য অনেক সময় রয়েছে। কোট পরে আস্তাবলে যায় আইওনা। ঘোড়াটিকে দেখে সেটির খাবার ও আবহাওয়া সম্পর্কে চিন্তা শুরু করে সে। একা থাকলে তার ছেলের কথা বারবার মনে পড়ে। অসহনীয় যন্ত্রণা।

আইওনা ঘোড়াটিকে দেখে বলতে শুরু করে, আজ যথেষ্ট উপার্জন করিনি। আমি গাড়ি চালানোর জন্য অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। আমার ছেলের গাড়ি চালানো উচিত, আমি না। সে একজন সত্যিকারের ক্যাবম্যান ছিলো। তার বেঁচে থাকা উচিত ছিল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর সে বলে, এরকমই হয়! কুজমা আয়নিচ চলে গেছে। পৃথিবী থেকে যাওয়ার আগে, সে আমাকে বিদায় জানিয়েছিলো। অকারণে চলে গেলো আমার ছেলেটি। তুমি তো আমার প্রিয় ঘোড়া। ধরো, তোমার একটি বাচ্চা আছে। আর তুমি সেই বাচ্চাটির মা। সেই বাচ্চাটি তোমার চোখের সামনে মারা গেলে…তুমি দুঃখিত হবে, তাই না?

ঘোড়াটি মনিবের কথা শুনে মাথা নাড়ায়। এরপর মনিবের হাতে শ্বাস ছাড়ে। তারপরই আইওনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর ছেলের বিয়োগ দুঃখ সম্পর্কে সব কিছু বলা শুরু করে। কথা শুনার মানুষ নেই। তাতে কী? এই বোবা প্রাণীটিই বুড়ো আইওনার কষ্টের কথা শুনার একমাত্র বিশ্বস্ত শ্রোতা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply