দেশে দেশে মৃত্যুদণ্ড

|

যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে এক আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো আসামিকে এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নজির নেই। বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে আলাবামার একটি জেলে তার ওপর এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, এটিই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সবচেয়ে ‘কম বেদনাদায়ক’ ও ‘মানবিক’ পদ্ধতি।

প্রশ্ন উঠেছে, প্রথাগত মৃত্যুদণ্ডের বাইরে গিয়ে কেন এই অপ্রথাগত পন্থায় যাওয়া? এর উত্তর হতে পারে– প্রাণঘাতী ইনজেকশনে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, মানুষ হত্যার কাজে তার বিক্রি নিষিদ্ধ ইউরোপে। যার প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর তাই দেশটির অনেক অঙ্গরাজ্যই খুঁজছে বিকল্প পন্থা।

ধরাধামে অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’। এর পন্থা ও কার্যকর করার প্রক্রিয়া একেক দেশে একেক রকম। আগে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারা হতো। আগুনে পুড়িয়ে মারা কিংবা শূলে চড়ানোর নজিরও গত হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। হাত-পা ছিঁড়ে ফেলে অপরাধীর মৃত্যু কার্যকর হতেও দেখেছে মর্ত্যবাসী। এখন অবশ্য বেশির ভাগ রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড প্রথা রদ বা হ্রাস করার পক্ষ নিয়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে প্রথম আইন হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা হাম্মুরাবির আইন অনুযায়ী ২৫টি ভিন্ন অপরাধের জন্য এ সাজা দেয়া হতো। এছাড়া, খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে এথেন্সের ড্রাকোনিয়ান কোড অনুযায়ী সকল অপরাধের একমাত্র শাস্তি হিসেবে কার্যকর করা হতো মৃত্যুদণ্ড।

কোন দেশে কীভাবে কার্যকর হয়?

এশিয়া মহাদেশের বেশিরভাগ দেশে, লাইবেরিয়া ও ওয়াশিংটনে ফাঁসির মাধ্যমে অপরাধীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। বর্তমানে ‘ফাঁসি’ সবচেয়ে প্রচলিত শাস্তি হিসেবে পরিচিত।

ক্যালিফোর্নিয়া, মিসৌরি ও এরিজোনা রাজ্যে গ্যাস চেম্বারে অপরাধীদের প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একটি আবদ্ধ ঘরে সালফিউরিক এসিড ও সায়ানাইডের সম্মিলিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করা হয়। এতে আসামির খিঁচুনি শুরু হয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে, সৌদি আরব ও কাতারে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্য্কর করা হয়। এই আইনটি ইসলামি শরিয়াহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

ইলেকট্রিক চেয়ারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কিছু অঞ্চলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই পন্থায় মৃত্যু ঘটাতে ওক কাঠের চেয়ার ব্যবহার করা হয়। আসামিকে সে চেয়ারে বসানোর পর মাথায় মেটালিক হেলমেট পরানো হয়, যাতে ইলেকট্রিক সংযোগ থাকে। প্রথম ৮ সেকেন্ডে ২৩০০ ভোল্ট এরপর ২২ সেকেন্ডে ১০০০ ভোল্ট প্রবাহিত করা হয়।

চীন, উত্তর কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ বেশ কিছু দেশে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আসামিকে একটি ঘরের মধ্যে দাঁড় করানো হয়। ২০ ফুট দূরত্বে পাঁচটি রাইফেল প্রস্তুত থাকে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি ছোড়া হয়।

উপমহাদেশ অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয় মৃত্যুদণ্ডের রায়।

মানবিক কারণে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যেমন কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। কানাডার নাগরিক হোক বা আশ্রিত, অন্য কোনো দেশেও যদি তার মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা থাকে, কানাডা তাকে ফেরত দেবে না। অন্য দেশে কানাডীয় কেউ ডেথ পেনাল্টির শিকার হলে কানাডা রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ ক্ষমা চাওয়ার কূটনীতি চালিয়ে যেতেও আইনত বাধ্য। কারণ, ভুলক্রমে নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যু হলে সেটা বিচারের অবমাননা বলে বিবেচিত হবে।

১৯৮৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডের হার।

মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে অ্যামনেস্টির তথ্য

২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। আগের পাঁচ বছরে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ডের হিসেব মিলিয়ে অ্যামনেস্টি বলে, অন্তত তেত্রিশটি দেশ একবার হলেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। সেখানে দেখানো হয়, কোন কোন দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। দেখানো হয়, কারা কারা এই প্রথা কার্যকরে সক্রিয় বা নিস্ক্রিয়।

• রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০৬টি দেশের আইন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে সমর্থন করে না।

• সাতটি দেশে যুদ্ধের মতো ‘বিশেষ অবস্থা’য় ভয়াবহ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।

• ২৯টি দেশের আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে কিন্তু থাকা সত্ত্বেও গত দশ বছরে এসব দেশ এ ধরনের কোনো চর্চা করেনি।

• ৫৬টি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল আছে। এর মধ্যে কোনো দেশ কার্যকর না করলেও কার্যকর যে করা হবে না– এমন কোনো সরকারি ঘোষণা নেই।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের লোগো সংবলিত ছবি।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তালিকায় কারা এগিয়ে?

২০২১ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তার চারটিই মধ্যপ্রাচ্যে। সেবছর গোটা বিশ্বে যে ৪৮৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তার ৮৮ শতাংশই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশ– ইরান, মিশর, ইরাক ও সৌদি আরবে।

অ্যামনেস্টির এই রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক দশকের মধ্যে ২০২০ সালেই সবচেয়ে কম সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে অ্যামনেস্টির এই সংখ্যায় চীনকে রাখা হয়নি।

ধারণা করা হয়, চীনে প্রতি বছর শত মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের তথ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপন রাখা হয়। উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামেও এই বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা বজায় থাকে। ফলে এসব দেশের পরিস্থিতি যাচাই করা প্রায় অসম্ভব।

২০২২ সালে ৮৮৩ জনের মৃত্যুদণ্ড 

২০২৩ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আরেকটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২২ সালে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালে ২০টি দেশে মোট ৮৮৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যা ২০২১ সালের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি। তবে এ সংখ্যা প্রতিবেদনে বরাবরের মতো চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি মানবাধিকার সংস্থাটি। কারণ, দেশটিতে ডেথ পেনাল্টির তথ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপন রাখা হয়।

অ্যামনেস্টি জানায়, এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে ২০২১ সালে ৫২০ জন এবং ২০২২ সালে ৮২৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ইরানে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের দাবিতে লন্ডনে এক প্রতিবাদ কর্মসূচি

উদ্বেগজনকভাবে চীনের বাইরে বিশ্বের মোট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ৯০ শতাংশই ঘটেছে এই অঞ্চলের মাত্র ৩টি দেশে। ইরানে ২০২১ সালে ৩১৪ জন এবং ২০২২ সালে ৫৭৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সৌদি আরবে ২০২১ সালে ৬৫ জন এবং ২০২২ সালে ১৯৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মিসরে গত বছর ২৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। 

চীন, উত্তর কোরিয়া এবং ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশে গোপনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদিও এসব দেশ ব্যাপকভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য পরিচিত। এর অর্থ হলো- বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। 

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply