যে ধর্মের পথে পবিত্র জীবনযাপন করেছে, আশা তার আত্মার সঙ্গী: গ্রীক কবি পিন্ডর

|

আহাদুল ইসলাম:

‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত’। পবিত্র কুরাআন মাজিদে সূরা আল ইমরানের ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এই চিরন্তন সত্য। তবে এটাও সত্যি, মানুষ মৃত্যুর পর বেঁচে থাকে তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে এমন কিছু লেখক ছিলেন, যাদের বই এখনও অমর হয়ে আছে। তেমনই একটি বই ‘প্লেটোর রিপাবলিক’। প্লেটো ছিলেন একজন গ্রীক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন আরেক মহাগুরু সক্রেটিসের শিষ্য। তার গুরু কখনোও কোন কিছু লিখে যাননি। সক্রেটিসের কাজ ছিল শুধু প্রশ্ন করা, উত্তর দেয়া নয়। অন্যদিকে, প্লেটো লিখতেন। গুরুর সব দর্শন, আলোচনা নিয়ে লিখেছেন, প্রচুর। এই বইটি লিখা হয়েছে সংলাপের ওপর ভিত্তি করে। আর ‘রিপাবলিক’ সংলাপের প্রধান কথক সক্রেটিস।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ থেকে ৪শ’ পর্যন্ত এথেন্স ও স্পার্টা শহরের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘পিলোপনেশীয়’ যুদ্ধ নামে বেশ পরিচিত। এই যুদ্ধে এথেন্স স্পার্টার কাছে পরাজিত হয়। দাস ও শ্রমজীবী মানুষের শোষণের ভিত্তিতে সামুদ্রিক এবং উপদ্বীপীয় গ্রীক বসতি ও সাম্রাজ্যের নেতা হিসাবে দীর্ঘদিন এথেন্সের যে আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল তা এই যুদ্ধে সংকটগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আইন, শৃঙ্খলা, শ্রদ্ধা, সম্মান, ভয় ইত্যাদির ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। গুপ্তহত্যা, বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহ এথেন্সীয় রাষ্ট্র এবং সমাজের সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সক্রেটিস ও প্লেটোর ধারনায়ঃ ন্যায়ের সার্বিক সংকট দেখা দেয়। সেই সময়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুস্থ করার দায়িত্ব চিন্তাবিদগণ, বিশেষকরে সক্রেটিস ও প্লেটো গভীরভাবে বোধ করেন। তাদের বিশ্বাস, পর্যাটন প্রতিষ্ঠিত নীতি বর্তমানের অরাজকতায় বিপদ্গ্রস্থ হয়েছে বলেই এথেন্স সর্বদিকে হীনশক্তি হয়ে পড়েছে। তাই ‘ন্যায়কে’ সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সক্রেটিস ও প্লেটো চলে যান এথেন্সের নকটবর্তী পাইরিউস বন্দরে প্রবীণ বণিক সিফিলাসের গৃহে। সেখানে তাদের সাথে ছিল গ্লকন এবং অ্যাডিম্যানটাস ( প্লেটোর দুই জ্যেষ্ঠ সহোদর), সিফিলাসের পুত্র পলিমারকাস, ত্রাসিমিকাস। সাথে ছিলো সক্রেটিসের তরুণ শিষ্যরা ছাড়াও আরও অনেক স্রোতা, যারা এই সংলাপের সাক্ষী।

সংলাপের পূর্বে বলে নেয়া ভালো, সিফিলাস ব্যবসা-বাণিজ্যে ধন লাভ করেছেন যথেষ্ট। সিফিলাস বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। তার মতে, অর্থ-সম্পদ জীবনের প্রয়োজন মাত্র। ব্যক্তির মনে শান্তির সৃষ্টি করতে পারে সেগুলো, তবে শান্তির মূল উৎস সততা ও ঈশর কিংবা মানুষ যার যা প্রাপ্য তা পরিশোধের দায়িত্ববোধ।

ঠিক এমন সময়ে শুরু সক্রেটিসের প্রশ্ন। বৃদ্ধ সিফিলাসকে প্রশ্ন করলেন সক্রেটিস, ‘তোমার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, কবিরা বলে, বার্ধক্যের বেলাভূমি’ যেখানে তুমি আজ, তুমি আমায় বলো জীবনের দিগন্ত কি সত্যিই কঠিন?

অভিজ্ঞ প্রবীণ সিফিলাস উত্তরে বললেন, ‘আমার অনেক বন্ধু যারা আমার মতো বয়সে বৃদ্ধ, অভিযোগের সুরে বলে ভাই! আর খেতে পারছি না!, কেউ বলছে কোথায় আজ জীবনের সেই রস! প্রিয়জনেরা আজ আমাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে, কেউ বলে বার্ধক্যই সব দুঃখের মূল; সোজা কথা তাদের দুঃখভরা কণ্ঠে যত করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়, তাদের সবার দায়িত্ব ‘বার্ধক্যের’ কাঁধেই বর্তায়।

তবে বৃথাই তারা বার্ধক্যকে দায়ী করছে। কারণ, বার্ধক্য যদি সব দুঃখের কারণ হত তাহলে বৃদ্ধ তো আমিও; আর সকলের মতো তো একই অভিযোগ আর দুঃখবোধের সৃষ্টি হত। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা এরূপ নয়। আমার সাথে একমত আরও অনেক বৃদ্ধ। যারা আত্মীয় স্বজনদের অবজ্ঞার স্বীকার, তারাও আসল কারণটি নির্ধারণ করতে পারেনা।

অবজ্ঞাত হওয়ার আসল কারণ বার্ধক্য নয়, আসল কারণ তাদের আপন চরিত্র এবং মেজাজ। কেননা, একথা আমরা জানি, যে চরিত্র শান্ত ও সুখী, সে তার বয়সের বোঝা আদৌ বোধ করে না। অপরদিকে, চরিত্রই যার বিপরীতধর্মী কী তারুণ্য কী বার্ধক্য; সবই তার নিকট ভার হয়ে দাঁড়ায়’।

সিফিলাসের এই কথা শুনে সক্রেটিস আবার প্রশ্ন করলেন, ‘সম্পদ থেকে কী শান্তি তুমি লাভ করেছ?’

সিফিলাস তখন বললো, ‘যে নির্ধন কিন্তু সৎ, তার কাছে যেমন বার্ধক্য কোনো বোঝাস্বরূপ বোধ হতে পারে না, তেমনি যে সম্পদ সমৃদ্ধ কিন্তু অসৎ, সে-ও কখনো অন্তরের শান্তি লাভ করতে পারে না’

কারণ পরলোকের সান্নিধ্য অথবা বয়সের আধিক্য- যে কারণেই হোক-না কেন, যখন বয়স ফুরিয়ে আসতে থাকে, তখন ব্যক্তির পরলোক সম্পর্কে তার দৃষ্টিটি বেশ পরিষ্কার হয়ে আসে, উদ্বেগ এবং আতঙ্কে তাই সে অস্থির হয়ে উঠে। সে ভাবতে শুরু করে, মর্তলোকের জীবনে কার প্রতি কোন অন্যায় সে করেছে। এই হিসাব-নিকাশে যখন সে দেখতে পায় যে, অন্যায়ের অংশ তার মোটেই কম নয়, তখন শিশুর মতো নিদ্রার মধ্যে দুঃস্বপ্নে সে আঁতকে ওঠে; মন তার নানা দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু অন্যায় থেকে যে মুক্ত, তার সম্পর্কে গ্রীক কবি পিন্ডর বলেছেন, যে ধর্মের পথে রয়েছে এবং পবিত্র জীবনযাপন করেছে, আশা তার আত্মার সঙ্গী; তারব বার্ধক্য আর পরলোকের পথে আশা তাকে ভরসা যোগায়; কারণ, দুশ্চিন্তায় অস্থির আত্মাকে শান্ত করার ক্ষমতা একমাত্র আশারই আছে।

এই উত্তর শুনে সক্রেটিস বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ সিফিলাস।

/এআই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply