জগৎজ্যোতি দাস ও ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ থেকে তার ‘বীর বিক্রম’ হওয়ার গল্প

|

আল মাহফুজ

মাঝেমাঝে মনে হয় ডাহুকের জন্য বাঁচি। রাতভর ডাকাডাকি।
মাঝেমাঝে মনে হয় শালুকের অপেক্ষা দেখি। দিনমান খয়েরি ঝিলে।
মাঝেমাঝে ভাবি নেরুদা হিকমতে ভাসি। শতাব্দী প্রাচীন অতল ঘর।
কখনও মনে হয় থাকি প্রিয় সিনেমার তরে। কুরোসাওয়া তারকোভস্কি।
মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ‘দাস পার্টি’র দলে ভিড়ি। জগৎজ্যোতি দাস কোথায়? 

ডাবল ডেকার বাসে করে রোজকার বাড়ি ফেরার পথে মাঝেমধ্যে চোখ পড়তো খিলগাঁওয়ে এক ফাস্ট ফুড ফ্রাঞ্চাইজির সামনের খালি অংশটাতে। সেখানে অনেক দিন একটি ছবি সাঁটানো ছিল। ছবিটি খুব সম্ভবত শহীদ আবদুল্লাহিল বাকীর। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাকে ফেলে রাখা হয় জলাভূমিতে। ছবিটি দেখলে কখনও মনে পড়তো চুকনগর গণহত্যার কথা। কখনও মনে পড়তো দেয়াড়া গণহত্যার কথা। অবশ্যই মনে পড়তো শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের কথা।

তখন অজান্তেই সন্তর্পণে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো কপোলে। চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যেতো। গলার স্বর আটকে যেতো। বিশুষ্ক বেদনায় হৃদয় আর্দ্র হতো। এমনও হয়েছে, কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারিনি। ঘন ঘন চশমার কাঁচ মুছতাম। পাশে বসা বন্ধুটি বলতো– বড় অকৃতজ্ঞ আর ভুলোমনা জাতি আমরা!

একাত্তরে ঈদের দিনে এভাবেই জগৎজ্যোতির মরদেহ বেঁধে রাখা হয় বিদ্যুতের খুঁটির সাথে।

ছবিটি শহীদ জগতজ্যোতি দাসের। একাত্তর সালে নভেম্বর মাসে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জ্যোতিকে মেরে সুনামগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে। মুক্তিকামী মানুষের বুকে ভয় ধরাতে জনসন্মুখে তার মরদেহের ওপর চলে পৈশাচিক বর্বরতা। মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি এলাকার মানুষকে দেখাতে ঈদের দিন তার মৃতদেহ বেঁধে রাখে বাজারের বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে। কিন্তু ক’জন জানেন জগৎজ্যোতি দাস সম্পর্কে? তার ‘দাস পার্টি’ সম্পর্কে?

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বৃহত্তর সিলেটের হাওর অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো অসীম সাহসী এক দল ছিল ‘দাস পার্টি’। এর কমান্ডার ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। মাত্র ৩৬ জন যোদ্ধার এই গেরিলা দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ভাটি অঞ্চলে। দাস পার্টির যোদ্ধাদের নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ করে একের পর এক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে জগৎজ্যোতি দেশকে অমর জ্যোতি উপহার দিয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে শক্রুমুক্ত করেছিলেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো দাস পার্টির সমর সমীকরণ সহজ ছিল না। ভাটি অঞ্চলে যুদ্ধক্ষেত্র। দুর্গম, প্রতিকূল ও বিপদসংকুল অঞ্চল। কিন্তু বুকভরা সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর দেশপ্রেম পুঁজি করে জগৎজ্যোতি ও তার ‘দাস পার্টি’ প্রত্যন্ত এলাকাকে করে তুলেছিলেন তীর্থভূমিরূপে। মুহুর্মুহু সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল জগৎজ্যোতি। অবশেষে ঘনিয়ে আসে তার অন্তিম অভিযান।

১৬ নভেম্বর ১৯৭১; দশ-বারো জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সাথে নিয়ে জ্যোতি তাড়া করেন রাজাকারদের। ভাণ্ডারে ছিল সামান্য গোলাবারুদ। অদূরেই ছিল হানাদারদের ক্যাম্প। কৌশলে তাদের সেখানে নিয়ে যায় স্থানীয় রাজাকাররা। দাস পার্টি আটকা পড়ে। আটকা পড়ে জগৎজ্যোতি। নিমিষেই বুঝে ফেলেন, চক্রব্যূহ সৃষ্টি করে তাঁদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তবু লড়াই করতে থাকেন বীরের বেশে। একপর্যায়ে ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতেই নিমিষে শত্রুপক্ষের ১টি গুলি জগৎজ্যোতির চোখে বিদ্ধ হয়। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে ঢলে পড়েন জ্যোতি। শরীরজুড়ে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো জ্যোতি শেষবারের মতো বলে ওঠেন– ‘আমি যাই গা…’। এরপরের ইতিহাস ব্যক্ত করে ওপরের ছবিটিই।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মুজিবনগর সরকার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদানের ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষিতে ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘আকাশবাণী’ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি দাস’ নামে প্রচার করতে থাকে। পরবর্তীতে, যুদ্ধজয়ী বাংলাদেশে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব পরিবর্তন করে তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। কেন এই খেতাব বদল, তার সুস্পষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি।

শহীদ জগৎজ্যোতি দাস ও তার দাস পার্টি বিষয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন লেখক হাসান মোরশেদ। বইয়ের নাম ‘দাস পার্টির খোঁজে‘। তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে– তখন সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতেই এরকম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি শুধু সামরিক কর্তাব্যক্তিরাই পাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাই জগৎজ্যোতি দাসকে দেশ স্বাধীন হবার পর ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে অলঙ্কৃত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখক অঞ্জলি লাহিড়ীর শিলংয়ের বাড়িতে জগৎজ্যোতি ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় পেয়েছিলেন। এতো এতো মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে একজন অল্প বয়সী (জগৎজ্যোতির জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৯৪৯) যোদ্ধার কথা তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। তাকে নিয়ে পরবর্তীতে লিখেছেন ‘জগৎজ্যোতি’ নামে একটি উপন্যাসও।

তিনি বলেন, এর আগে জগৎ ১৭ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসে। তার শরীরে কয়েকটি স্প্লিন্টারও ছিল। শেষবার যাওয়ার সময় সে আমার বাসায় আসে। এসে তারা কয়েকজন বলে– দিদি, খেতে দাও। পাকিস্তানি বার্জ আসছে। আক্রমণ করতে হবে। আমি তাকে বারণ করলাম। সে শুনলো না। পরে আক্রমণে গিয়ে ধরা পড়ে জগৎ। তাকে মেরে মরদেহ আজমিরীগঞ্জ বাজারে একটি বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজমিরীগঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল ‘জগৎজ্যোতিগঞ্জ’। কিন্তু এটাও পরবর্তীতে অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকতে পারেনি। বর্তমানে ওই অঞ্চলের নাম ‘আজমিরীগঞ্জ’ই। একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিলেন অথচ আমরা সামান্য একটা নামফলকে তার অসামান্য নামটি লিখে রাখতে পারলাম না!

জগৎজ্যোতি মানে পৃথিবীর আলো। আমাদের গর্ব, এ দেশে একজন ‘জগৎজ্যোতি’ ছিল। যার বুকপকেটে এক পৃথিবীর সকল আলো ছিল কিনা জানি না, তবে ছিল লক্ষ-কোটি মানুষের মুক্তির আভা। ভাটি অঞ্চলের এই বীর ও তার সঙ্গীরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য আলো জ্বেলে গিয়েছিল। সেই আলো কি এখন আমরা দেখতে পাই? সেই আলোতে কি আজকাল আমাদের দুচোখ ঝলমল করে ওঠে? নাকি আঁধারেই খেই হারায়?

আমি আমার পূর্বপুরুষের নীল রক্তের ঋণ অস্বীকার করি
আমি সূর্যের মাথায় ঠ্যাকা বন্দুকের নল অস্বীকার করি
অস্বীকার করি গণকবরের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা রক্তজবা
আমি অস্বীকার করি বর্ণিল বাগানের সফেদ বিদ্রোহী মালিদের
নাবালক কবিতার গোটা ত্রিশেক পংক্তি আমি অস্বীকার করি
মেঘের জরায়ু ছিঁড়ে নামা জলের রংধনু আমি অস্বীকার করি
আমি ক্রমশ ভুলে যেতে ভালোবাসি
আমি অস্বীকার করতে ভালোবাসি

তথ্যসূত্র:

  • দাস পার্টির খোঁজে, হাসান মোরশেদ
  • শিলং পাহাড়ের সেই বীরাঙ্গনা, শুভাশিস চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
  • একাত্তরে খুলনা, মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস
  • শহীদ জগৎজ্যোতি দাস, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, একতা
  • ইতিহাসের বিস্মৃত এক মুক্তিযোদ্ধা, একেএম শামসুদ্দিন, যুগান্তর
  • আজমিরিগঞ্জের নাম ‘জগৎজ্যোতিগঞ্জ’ পুনর্বহাল করা হোক, পি.সি.দাশ.পীযূষ, সুনামগঞ্জের খবর

সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply