বাংলাদেশের মানুষ ‘মায়ের মতো ভালো’: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়

|

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়ের অন্ত নেই। জনপ্রিয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার। তিনি ফিল্মমেকার, অভিনয়ও করেন। তবে সে সাবজেক্টে লেটার মার্কস দেন না। যিনি কখনও ভাবেননি, বাসরঘর আর কলেজ ফেস্ট ছাড়া কোথাও তার গানের যাত্রা হবে বহমান। যে জীবন যাপন করা হয় না আর কারও, সেই নাবালক জীবন বারবার স্পর্শ করেন বোহেমিয়ান ঘুড়ির মতো। দুই বাংলার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র অন্যতম প্রধান গায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অনিন্দ্য। তার লেখায়ও ঝরে পড়ে ঝরঝরে হিউমার আর বক্র বাস্তবতা।

সব্যসাচী অনিন্দ্যকে নিয়ে বই লিখেছেন সাজ্জাদ হুসাইন। ‘অনিন্দ্যকাল’ শিরোনামে সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে অংশ নিতে কলকাতা থেকে ঢাকায় উড়ে এসেছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় বইটির প্রকাশনা উৎসব। সেখানে কথার অর্গল খুলে দেন ‘চন্দ্রবিন্দু’র নরম গায়ক।

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশে এসে খুব ভালো লাগছে। দীর্ঘ এগারো বছর পর গত ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা (চন্দ্রবিন্দু) গান করতে এসেছিলাম। সেটা ছিল আমাদের জন্য অনাস্বাদিত এক অভিজ্ঞতা। হাজার হাজার মানুষের মুখে ‘ভিনদেশী তারা’ গাইতে দেখাটা আমাদের জন্য ছিল গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো এক অভিজ্ঞতা। ঢাকাবাসীকে একারণে আন্তরিক ধন্যবাদও জানান শিল্পী।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও লেখক সাজ্জাদ হুসাইন তার কাছে জানতে চান, ‘ভিনদেশী তারা’ গানটি কীভাবে উদ্ভাবন বা উদ্বোধন হয়েছিল। গীতিকার অনিন্দ্যর জবাব, অন্য কোথাও এটা জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, প্ল্যানেটারিয়াম দেখে বেরিয়ে গানটি লিখেছিলাম (দর্শকের হাসি)। কিন্তু এখানে সেটা বলা যাবে না। ভিনদেশ মানে ভিসা-ইমিগ্রেশন নয়। ভিনদেশ মানে আমি যেখানে বড় হয়েছি, আমার সত্তা বা মন যেখানটাতে থাকে, সেখান থেকে আপরুটেড হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। আমাদের প্রায় সবার জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি অনেকটাই এরকম।

কথা বলছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়

তিনি বলেন, যতই আমি সৌরজগত নিয়ে কথা বলি না কেন, ‘ভিনদেশী তারা’ আদতে একটি প্রেমের গান। এটি এমন প্রেমের গান, যার কাছে সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তার সত্যিই খুব আকাশছোঁয়া বাড়ি, যে বাড়ির নাগাল আমার করায়ত্ত নয়। অনিন্দ্য কথামালা চলতে থাকে– শিল্পীরা স্বভাবত মিথ্যুক হয়। তাদের সৃষ্টিতে দশ শতাংশ সত্য থাকে, নব্বই শতাংশ থাকে মিথ্যে। তবে রঙ ছড়িয়ে বলার নামই একপ্রকার শিল্প। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে দর্শকের সঙ্গে গানটি গেয়ে শোনানও এই গায়ক।

সাজ্জাদ হুসাইন ফেসবুকে লিখেছিলেন, বাংলা গান লিখেছি। শুনেছিও। কিন্তু একটা গানের একটা কথা শুনে জীবনে প্রথম চমকে উঠেছিলাম। একটা গানে একজন গাইছেন– ‘তুমি মায়ের মতোই ভালো, আমি একলাটি পথ হাঁটি’। এমন আশ্চর্য একটা কথা লিখতে পারলে জীবনে আর কখনও লিখতামই না। সঞ্চালক নাছোড়বান্দা। দুটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, লিরিকের এই ভার্সটার জন্ম কীভাবে? বাংলাদেশের সাথে অনিন্দ্যর সম্পর্কটা কেমন?

সব্যসাচীর সাবলিল উত্তর– প্যারালাল প্রশ্ন কিন্তু দুটি প্রশ্নের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। আমি বড় হয়েছি কলকাতার উত্তর প্রান্তে। বাড়িতে বৃষ্টির জল উঠে যেতো। তবে আমার মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা কানেকশন আছে। মায়ের পরিবারের নাড়ি পোঁতা এই দেশেই। ফলে বাংলাদেশ আমার কাছে ‘মায়ের মতোই ভালো’। বাংলাদেশের মানুষ ‘মায়ের মতোই ভালো’।

বইয়ের লেখক সাজ্জাদ প্রসঙ্গে গায়ক বলেন, আমাকে দিয়ে এই বই লেখাতে গিয়ে ওর অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছে। ও বোধহয় তিন-চার মাস ধরে ফোন করতো আমায়। ওকে দেখতে আপাত ভদ্র মনে হলেও ওর একটা নাছোড় ক্ষমতা রয়েছে লেগে থাকার। শেষদিকে ওর ফোন পেলেই আমি তটস্থ থাকতাম। আমি বলতাম যে, বইটা করার দরকার নেই । তার কারণ হলো, আমার মনে হয়, এসব বই তাদেরই বের হয়, যারা বুড়ো হয়ে গেছে (হাসি)!

প্রকাশনা উৎসবে আসা দর্শকের একাংশ

হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় এরপর অনিন্দ্য বলেন, কোভিডের অনেক পরে সাজ্জাদের সঙ্গে আমার বসা হয়। আমি বলেছিলাম, বিখ্যাত হওয়ার পর তালির গল্প মোটের উপর একই রকম। সাফল্য পেলে সেলফি তোলার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু জীবনের আসল মজা হচ্ছে রসদ সংগ্রহ করার সময়কাল। সেই সময়কাল ভাঙ্গিয়ে সারাজীবন আমার চলছে। অর্থাৎ, এখন আমি সাহেবি জুতো পরে আছি কিন্তু যে বয়সের আমি নিয়ে লেখাটা হয়েছে, তখন পকেটে কানাকড়ি থাকতো না। তখন বন্ধুরা বাসের টিকিট কেটে দিলে খুব খুশি হতাম।

প্রসঙ্গত, লেখক সাজ্জাদ হুসাইন ইতোমধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, শাফিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন গুণী শিল্পীকে নিয়ে বই লিখেছেন। বছর তিনেকের যাত্রা শেষে লিখেছেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলির গান’। তারই ধারাবাহিকতায় এবার এসেছে ‘অনিন্দ্যকাল’। প্রকাশিত হয়েছে ‘ছাপাখানার ভূত’ থেকে। বইমেলায় বইটি পাওয়া যাবে ৫১৩ নম্বর স্টলে।

গ্রন্থনা: আল মাহফুজ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply